hypothyrodism

হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসা ব্যাবস্থা

থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরয়েড হরমোন কম নিঃসরণের ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়  হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয় ।  থাইরয়েড হল আমাদের গলার নীচে  অবস্থিত প্রজাপতি আকারের একটি গ্রন্থি যা থেকে নিঃসৃত হরমোন মানুষের নানা বিপাকীয় ক্রিয়া, মানসিক বিকাশ ইত্যাদিতে ভুমিকা রাখে। শরীরের অন্যান্য স্থানের মতো থাইরয়েড গ্রন্থিতেও বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে , তার মধ্যে হাইপোথাইরয়েডিজম এক অন্যতম পরিচিত সমস্যা । 

বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে যে হাইপোথাইরয়েডিজম পুরুষদের তুলনায় মহিলাদেরই ( ৮ গুন বেশী ) বেশী হয়ে থাকে । ভারতে থাইরয়েড রোগের মধ্যে হাইপোথাইরয়েডিজম খুবই সাধারন ব্যাপার যেখানে প্রতি ১০ জনে ১ জন এই ব্যাধির শিকার হন । ৫ই জুন, ২০১৪ চেন্নাই এ থাইরয়েড সংক্রান্ত ভিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এক অনুষ্ঠিত সন্মেলনে বিশেষজ্ঞরা বলেন যে ভারতে মোট ৪২ মিলিয়ন এই ব্যাধি তে আক্রান্ত রয়েছেন এবং এটা এখন আরও বেড়ে গেছে । আজকে এই লেখাতে আমরা হাইপোথাইরয়েডিজম এর অনেক খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে জানবো ।

হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ বা উপসর্গ

থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরয়েড হরমোন কম নিঃসরণের ফলে  বিভিন্ন উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায় যেমন –

  • মাসিক চক্রের পরিবর্তন।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য।
  • বিষন্নতা।
  • শুষ্ক চুল এবং চুল পড়া।
  • শুষ্ক ত্বক।
  • কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া।
  • ক্লান্তি।
  • ঠান্ডা তে বেশি সেনসেটিভ হয়ে পড়া।
  • সংবেদনশীলতা।
  • কর্কশ কণ্ঠ
  • জয়েন্টে ব্যাথা,শক্ত হয়ে যাওয়া বা মাংসপেশি ফুলে ওঠা।
  • স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া।
  • পেশীর দুর্বলতা।
  • মুখ ফুলে যাওয়া।
  • হৃদস্পন্দন কমে যাওয়া।
  • থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে ওঠা (goiter)
  • ওজন বেড়ে যাওয়া ।
Over Weight

হাইপোথাইরয়েডিজম বাচ্চাদের হলে তার কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে , তবু নীচের লক্ষণগুলি দেখা যেতে পারে – 

  •  হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া।
  •  কোষ্ঠকাঠিন্য
  •  অতিরিক্ত ঘুমানো।
  •  কর্কশ কান্না।
  • বৃদ্ধি না হওয়া।
  • পেশী ফুলে ওঠা।
  • অবিরাম জন্ডিস হহওয়া।
  • খারাপ খোয়ার অভ্যেস।
  • মুখ, পেট বা জিভ ফুলে ওঠা।

হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণ

হাইপোথাইরয়েডিজমের সবথেকে সাধারণ কারণ হল হাশিমোটো থাইরয়েডাইটিস নামক প্রদাহ । হাশিমোটো থাইরয়েডাইটিস একটি অটো ইমিউন ডিসঅর্ডার। এটি আমাদের শরীরে কিছু অ্যান্টিবডি তৈরি করে যেগুলি থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমন করে এবং ধ্বংস করে দেয়। তাছাড়া হাইপোথাইরয়েডিজ হওয়ার জন্য আরও অনেক কারন রয়েছে , যেমন –

ওষুধ ব্যবহার করা

হার্টের সমস্যা, মানসিক অবস্থা এবং ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্যে কিছু ওষুধ কখনো কখনো থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদনকে প্রভাবিত করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যামিওডেরোন (কর্ডারোন, পেসারোন), ইন্টারফেরন আলফা এবং ইন্টারলিউকিন-২।

থাইরয়েড সার্জারি 

থাইরয়েড অপরেশনের জন্য অস্ত্রপচার করা হলে তা হাইপোথাইরয়েডিজম হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় । যদি থাইরয়েডের শুধুমাত্র কিছু অংশ অপরেশন করা হয় তাহলে অবশিষ্ট গ্রন্থিটি তখনও শরীরের প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট হরমোন তৈরি করতে সক্ষম থাকে । 

খাবারে আয়োডিনর অভাব

থাইরয়েডের হরমোন তৈরির জন্য আয়োডিন প্রয়োজন। আপনার শরীর নিজে থেকে আয়োডিন তৈরি করতে পারে না তাই এটি আপনার খাদ্যের মাধ্যমেই তৈরি হয় এবং লবণ হল আয়োডিন সমৃদ্ধ। আয়োডিনের অন্যান্য খাদ্যের মধ্যে রয়েছে লবণাক্ত প্রাণীর মাছ, ডিম, দুগ্ধজাত পণ্য এবং সামুদ্রিক শৈবাল। 

প্রেগনেন্সি

কারণ স্পষ্ট নয় তবুও কখনো কখনো থাইরয়েডের থেকে উৎপাদিত হরমোনের ঘাটতি গর্ভবতী অবস্থায় ঘটে। একে বলে পোস্টপার্টাম থাইরয়েড (Postpartum Thyroid)। এই অবস্থায় মহিলাদের থাইরয়েডের হরমোনের মাত্রা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায় এবং তারপর থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনের তীব্র ঘাটতি ঘটে এবং এই রোগে আক্রান্ত হলে বেশিরভাগ মহিলা তাদের স্বাভাবিক থাইরয়েডের কার্যকারিতা ফিরে পান না।

থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ে জন্মানো

কিছু শিশু জন্মগ্রহণের পরে তাদের থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিকভাবে কাজ করে না বা বিকাশিত হয় না। এই ধরনের  হাইপোথাইরয়েডিজম কে জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়।

পিটুইটারি গ্রন্থি

আপনার পিটুইটারি গ্রন্থিতে সমস্যা থাকলে সেটা থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

হাইপোথ্যালামাস এর সমস্যা

যদি আপনার ব্রেনে হাইপোথ্যালামাস সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে সেটা হাইপোথাইরয়েডিসমের কারণ হতে পারে।

রেডিও অ্যাকটিভ আয়োডিন ট্রিটমেন্ট

এই চিকিৎসাটি সাধারণ এবং এমন লোকেদের জন্য নির্ধারিত করা হয় যাদের অত্যধিক সক্রিয় থাইরয়েড গ্রন্থি রয়েছে যা হাইপারথাইরয়েডিজম নামে পরিচিত। এই চিকিৎসার বিকিরণ পদ্ধতির ফলে থাইরয়েড গ্রন্থির কোশ ধ্বংস করে এবং এটি হাইপোথাইরয়েডিজম দিকে পরিচালিত করে। 

Thyroid test

হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা 

হাইপোথাইরয়েডিজম এর কনও স্থায়ী চিকিৎসা ব্যাবস্থা নেই কিন্তু আপনি যদি এই রোগের কবলে পড়েন তাহলে ডাক্তার আপনাকে থাইরক্সিন (T4)  এবং থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (TSH)  টেস্টের কথা বলবেন এবং প্রয়োজনে মানুষের  তৈরি সিন্থেটিক থাইরয়েড হরমোন T4 নেওয়ার উপদেশ দেবেন। এছাড়াও তিনি আপনার জন্য নিয়মিত ওষুধ এর ব্যবস্থাও করতে পারেন ।

হাইপোথাইরয়েডিজমের জটিলতা 

  • আপনাকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে সিন্থেটিক হরমোন আপনার শরীর নিতে পারছে কিনা। এছাড়াও নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা বা থাইরয়েড হরমোন লেভেল পরীক্ষা আপনাকে করাতে হবে। এবং তার রিপোর্ট দেখে আপনার ডাক্তার আপনার ওষুধের ডোজ সময়ের সাথে সাথে বদলে দেবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেই সিন্থেটিক থাইরয়েড হরমোনের ডোজের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন শরীরে কাঁপুনি বা কম ঘুমাতে পারা। 
  • থাইরয়েডের সমস্যা কোনো প্রেগনেন্ট মহিলার হলে তার সন্তানের বিপদের আশঙ্কা থাকে। কারণ প্রথম তিনমাস তার সন্তান পুরো থাইরয়েড হরমোন তার মায়ের থেকে নেয়। কোনো মায়ে হাইপোথাইরয়েডিজমহলে সেই বাচ্চা ঠিকঠাক ভাবে থাইরয়েড হরমোন পায়না আর এতে তার মস্তিষ্কের বিকাশ সঠিক ভাবে নাও হতে পারে । 
  • থাইরয়েড হরমোন শরীরে অত্যন্ত কম উৎপাদন হলে জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ একটা রোগ মাইক্সেডিমা হতে পারে। এটি হল হাইপোথাইরয়েডিসমের সবচেয়ে গুরুতর পর্যায়। কোনো মানুষের এই রোগ থাকলে সে যেকোনো সময় জ্ঞান হারাতে পারে বা কোমায় চলে যেতে পারে। এই অবস্থায় একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক তাপমাত্রা অত্যধিক কমে যেতে পারে ফলে তার মৃত্যুও হতে পারে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

You cannot copy content of this page

Scroll to Top