মলত্যাগে ঘন ঘন (Irregular bowel movements) অসুবিধা জীবনের সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয়গুলির মধ্যে একটি। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার অভ্যাস যেমন, কাজের ব্যস্ত সময়সূচি, জাঙ্ক ফুড খাওয়া, অনিয়মিত খাবার খাওয়া, কম ফাইবার খাওয়া এবং অপর্যাপ্ত ঘুম সব কারণেই কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্যে যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে তা ভীষণ উদ্বেগের কারণ।
কোষ্ঠকাঠিন্য কেন হয়?
নানাবিধ কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কমন ও গুরুত্বপূর্ণ ৬টি কারণ হলো—
1.খাবারের তালিকায় যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ না থাকা
2.পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান না করা
3.শুয়ে-বসে থাকা ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাব
4.পায়খানার বেগ আসলে তা চেপে রাখা
5.মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা
6.ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
কোষ্ঠকাঠিন্য (কোষ্ঠবদ্ধতা) এর উপসর্গ –
1.স্বাভাবিক পেট পরিষ্কার না হওয়া।
2.সম্পূর্ণ পেট পরিষ্কার না হওয়ার অনুভূতি।
3.মলত্যাগের সময় অসুবিধা অথবা যন্ত্রণা।
4.মল শক্ত হওয়া বা এঁটে যাওয়া।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই উপসর্গগুলির উপশম হওয়া প্রয়োজন, না হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যাবে এবং নানা উপসর্গ দেখা দেবে। যেমন-
1.মলত্যাগের সময় রক্তক্ষরণ।
2.কোষ্ঠকাঠিন্যের সঙ্গে পেট ব্যাথা।
3.গ্যাস বা বায়ু নির্গত করার সমস্যা।
4.বমিভাব এবং বমি।
5.জ্বর।
6.পিঠে ব্যাথা ।
7.ওজন কমে যাওয়া।
ঘরোয়া প্রতিকার
কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে ঘরোয়া প্রতিকার সাহায্য করতে পারে। কিছু সহজ প্রতিকার নিচে বিবৃত হল:
●হিং – এক গ্লাস উষ্ণ জলে দু’চিমটে হিং ফেলে দিন দিনে দু’বার খেতে হবে।
●জোয়ান – এক চা চামচ জোয়ান প্যানের মধ্যে শুকনো ভেজে গুঁড়িয়ে নিতে হবে। উষ্ণ জলের সাথে পান করতে হবে।
●জল – যদি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা খুব বেশি হয় তাহলে দিনের শুরু এক গ্লাস উষ্ণ জল দিয়ে করতে হবে যা পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করবে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ওই জল খেতে হবে। দিনভর নির্দিষ্ট সময় অন্তর জল পান করতে হবে।
●কফি – ক্যাফিন হচ্ছে একটি সাধারণ জোলাপ এবং অত্যন্ত মৃদু প্রকৃতির। এক কাপ কালো কফি তৈরি করে সকালে খেতে হবে। তবে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয় যে, কেউ যেন এই প্রতিকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পড়েন, কারণ ক্যাফিন থেকে ডিহাইড্রেশন হতে পারে ( জলশূন্যতা) এবং রাত্রে কফি খেলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্যে কী করবেন?
1. দিনে ৩–৩.৫ লিটার জলপান করতে হবে। শীতের সময় কিছুটা কম হলেও চলে।
2. রোজকার ডায়েটে রাখুন পাঁচ রকমের শাকসবজি। আলু-পেঁয়াজ ছাড়া সময়ের সব রকমের সবজি খেতে হবে। ঢেঁড়স কনস্টিপেশন কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।
3. যারা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছেন, তারা নিয়ম করে দুবেলা ঢেঁড়স খেলে সমস্যা থেকে রেহাই পাবেন।
4. পালংশাক থাকুক মধ্যাহ্নভোজনে।
5. কুমড়ো, লাউ, পটোলসহ সময়ের সবজি খেতে হবে। খোসাসহ সবজি খাওয়া উচিত।
6. কলা, পেয়ারা, লেবু, আম, জামসহ বেশিরভাগ ফলেই ফাইবার আছে। নিয়ম করে দিনে ৩-৪টি ফল খেলে ভালো হয়।
কী করবেন না
1. বাথরুমে গিয়ে অনেক ক্ষণ বসে চাপ দেবেন না। এতে সমস্যা বাড়ে।
2. নিয়মিত ব্যায়াম করে ওজন ঠিক রাখুন। বাড়তি ওজন পাইলসের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়।
3. ভারী জিনিস তুলবেন না।
4. ধূমপানের অভ্যাস থাকলে ছেড়ে দিতে হবে।
5. মদ্যপানে সমস্যা বাড়ে।
6. ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন।
7. খাবাবের নামে ঝলসানো মাংস খাবেন না।
8. ময়দার খাবার খেলে সমস্যা বাড়ে। চাউমিন ময়দায় তৈরি হয়। মোমোও তাই। সুতরাং এ ধরনের খাবার বাদ দিন।
9. কেক, বিস্কুট মাত্রা রেখে খান। পরিবর্তে খই, ওটস খেতে পারেন।
10.পাইলস হলে সময় নষ্ট না করে শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে
কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীদের কয়েকটি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন চা, কফি, কোক জাতীয় ড্রিঙ্কস, চকলেট, অত্যাধিক মশলাযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত তেল, ঘি, মাখন, ভাজা খাবার না খাওয়া ভাল। মিহি চালের ভাত, ময়দার রুটি, পরাটা, লুচি, পাউরুটি, চিড়া, মুড়ি ইত্যাদি খাবার না খাওয়াই বাঞ্ছনীয়। মদজাতীয় পানীয় খাওয়া নিষেধ। ধূমপানের মাত্রা কমাতে হবে, খুব ভাল হয় একেবারে বন্ধ করলে। রেডমিট মানে খাসী বা গরুর মাংস না খাওয়া ভাল।
খাদ্যতালিকা-
প্রতি ১০০০ কিলোক্যলরি খাবারে ১৪ গ্রাম ফাইবার বা আঁশ জাতীয় খাবার থাকতে হবে। যদি সারাদিনে দুই হাজার কিলোক্যলরি খাবার প্রয়োজন হয় তাহলে ২৮ গ্রাম ফাইবার বা আঁশ জাতীয় খাবার খেতে হবে।আমাদের দেহ এই আঁশকে হজম করতে পারে না। তবে এটি বৃহদান্ত্রে প্রবেশ করে মলত্যাগকে উদ্দীপ্ত করে। আঁশ মলের কোমলতা ও পরিমাণ বৃদ্ধি করে।গমের রুটি, ঢেকি ছাটা চাল, শস্য, শিম বরবটি, মটর বিভিন্ন ধরনের ডাল, শাকসবজি বিশেষত পাতা জাতীয় সবজি ও টাটকা ফলে যথেষ্ট আঁশ থাকে।
বিভিন্ন প্রকার শাক, তরি-তরকারি যেমন: আলু, পেঁপে, গাজর, কাঁচা ডাটা, সিম, বরবটি, লাউ, কুমড়া, এগুলোর বাইরের আবরণ মূলতঃ সেলুলোজ। এই সেলুলোজকে আঁশও বলা হয়। বিভিন্ন ফলের ছোবড়া, চাল, গম ইত্যাদির বাইরের অংশও সেলুলোজ । শাক-সবজি কাঁচা ও টাটকা খেলেই বেশী উপকার পাওয়া যায়। আলু, পটল, মূলা খোসা না ফেলে রান্না করাই উত্তম। আপেল খোসাসহ খাওয়াই ভালো। তুষের সেলুলোজ কোষ্ঠবদ্ধতা দূর করে বলে মেশিনে ছাঁটা চালের চাইতে ঢেঁকি ছাঁটা চাল বেশি উপকারী। কাগজিলেবু, বাতাবিলেবু, কমলালেবু, টমেটো, আপেল এগুলোতে জৈব এসিড থাকে। এই এসিড অন্ত্রে উত্তেজনা সৃষ্টি করে মলত্যাগে সাহায্য করে। এইজন্য সকালে খালি পেটে এ ধরনের ফল বা ফলের রস খেলে কোষ্ঠবদ্ধতা দূর হয়।শাকসবজি এবং ফল অনেক বেশি খেলে কারো কারো পেট ফাঁপা সমস্যা দেখা দেয় বা পেটে গ্যাস হয়। এজন্য শাকসবজি যখন খাওয়া শুরু করবেন তখন অল্প অল্প করে খাওয়া শুরু করবেন। হঠাৎ করে কখনো শাকসবজি বেশি খাওয়া শুরু করলে পেটের সমস্যায় পড়তে হবে।যেসব খাবারে ফাইবার বা আঁশ কম আছে যেমন বিভিন্ন প্রসেসড ফুড এবং মাংস কম খেতে হবে।
পেয়ারা এবং পেঁপে এই দুটি ফল কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীর জন্য অমৃতের মতো। এই ফলগুলো দিনের যে কোন সময় খাওয়া যেতে পারে।আঙ্গুরে কোষ্ঠকাঠিন্য বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। শুকনো আঙ্গুর অর্থাৎ কিসমিস কয়েক ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে খেলে অন্ত্রকে শক্তি দেয় এবং ডায়রিয়া সহজে আসে।ডুমুর কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার একটি ফল।কিসমিস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ঘুমানোর সময় প্রতিদিন 7 টুকরা শুকনো কিসমিস আঙ্গুর খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য স্থায়ী সমাধান হয়। ইসবগলের ভুসি কোষ্ঠকাঠিন্যে অত্যন্ত উপকারী। 2-3 চামচ ইসবগোল ভুসি দুধ বা জলের সাথে ঘুমানোর সময় খাওয়া উপকারী।
আপনার যদি র্দীঘদীন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্য বা কষা পায়খানা থাকে,অথবা পায়খানার রাস্তায় ব্যাথা হয় এবং পায়খানার খুব শক্ত ও রং কালো হয়। যদি পায়খানার সাথে রক্ত আসে। এমনকি পেট ফাঁপা থাকে, হজম শক্তি কমে যায়। এই কোষ্ঠকাঠিন্যের সাথে যদি পেটব্যাথা হয়, জ্বর আসে, বিশেষ করে যদি কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমে যায় এবং রক্তশুণ্যতা থাকে তাহলে অবশ্যই একজন ভালো ডাক্তার এর কাছে থেকে পরামর্শ নেবেন।