সদ্য তেরো পার হওয়া কিশোরটি হঠাৎ-ই রেগে গিয়ে বাবা-মায়ের উপরে চিৎকার শুরু করে৷ শুধু চিৎকার নয়, রীতিমতো বিদ্বেষমূলক আচরণ। মানসিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ ছেলের রেগে গিয়ে হঠাৎ এমন আচরণে ঘাবড়েই গিয়েছিলেন বাবা-মা। লকডাউনের সময়ে কোনও চিকিৎসকের কাছে যাওয়াও সম্ভব নয়। শেষ অব্ধি দারস্থ হতে হয় সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলরের কাছে। সেখানে কাউন্সেলিং করানোর পরে সমস্যা কিছুটা কম হয় ওই কিশোরের।
বছর পনেরোর এক কিশোরী আবার মা যা-ই বলছেন, তাতেই রেগে যাচ্ছে। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা আর তার জেরে লকডাউন— সব মিলিয়ে বড়দের পাশাপাশি ছোটদের মনের উপরেও তৈরি হচ্ছে প্রবল চাপ। যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কেউ কেউ রেগে যাচ্ছে। অথচ, বাবা-মায়েরা বুঝতে পারছেন না, হঠাৎ কী হল! এমন পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েদের কী ভাবে সামলাবেন, তা-ও বুঝতে পারছেন না অনেকেই। আর সেই কারণেই গত কয়েক দিন ধরে ক্রমাগত ফোন এসেছ রাজ্য শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের হেল্পলাইনে। বাবা-মায়েদের করণীয় কী, ফোনেই তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন কমিশনের মনোরোগ চিকিৎসক ও মনোবিদেরা। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে, কমিশনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে লকডাউনে ছোটদের মানসিক স্বাস্থ্যের হাল নিয়ে। সংখ্যাটা ক্রমবর্ধমান বলেই তাদের ধারণা।
আনলক প্রক্রিয়া শুরু হলেও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ স্কুল। টিউশন ও সারতে হচ্ছে অনলাইনেই৷ ভীষণ ভাবে বিঘ্নিত হয়ে চলেছে মানসিক স্বাস্থ্য, বেড়েছে অকারণ উৎকন্ঠা। তাতেই জেরবার শিশু থেকে কিশোর-কিশোরী সকলেই৷
কমিশনের কাউন্সেলর একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এখনকার বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরীরা কেউ হয়তো নিজের ঘরে কিছুটা সময় একা কাটাতে চায়। কেউ আবার বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করে গল্পগুজবে মেতে থাকতে পছন্দ করে। অন্য সময়ে তা সম্ভব হলেও লকডাউনের জেরে মা-বাবারা সারা দিনই বাড়িতে থাকায় কিশোর-কিশোরীরা সেই সময়টুকুও পাচ্ছে না। অনেক বাবা-মা আবার কারণে-অকারণে বারবার ঘরে ঢুকে ছেলে-মেয়ে কী করছে, তাতে নজর রাখতে শুরু করেছেন। ফলে নিজের মতো করে সময় কাটাতে না-পারায় মনের উপরে চাপ বাড়ছে কিশোর-কিশোরীদের। এক-এক সময়ে সেই চাপ সীমা ছাড়িয়ে গেলে প্রচণ্ড রেগে যাচ্ছে তারা।

কর্মরত বাবা-মায়েদের অনেকে আবার এই সময়ে ঘরে বসে বাড়ির পাশাপাশি অফিসের কাজও সামলাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দুটো কাজের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে না পেরে তাঁরা নিজেরা চাপে থাকছেন। যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে সন্তানের উপরেও। যদিও পুরো বিষয়টির জন্য বাবা-মায়েদের দোষ দিতে পারছেন না তিনি। আরও বলেন “করোনার জেরে শুধু ঘরে বন্দি থাকাই নয়, ভবিষ্যৎ ভাবনাও তাঁদের উপরে চেপে বসেছে। এই অতিমারির শেষে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিও যে বদলে যাবে, সেটা এখন থেকেই সকলে বুঝতে পারছেন। সেই চাপও নিতে হচ্ছে বাবা-মায়েদেরই।’’
তাঁর মতে, বাবা-মা যখন বাড়ির কাজ করছেন, তখন ছেলেমেয়েকে তাতে একটু যুক্ত করে নিলে তারাও বুঝতে পারে, তাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন বাবা-মা। আর বাকি সময়ে নজরে রাখলেও বাড়াবাড়ি না করলেই ছেলেমেয়েরা ভাল থাকবে।
একটি সংবাদপত্রে এর থেকে বেরোনোর রাস্তা বলে দিয়েছেন মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুল বন্ধ থাকলেও ছেলেমেয়েকে নিয়ম করে পড়তে বসানো উচিত। পাশাপাশি তাদের পছন্দের সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দেওয়া এবং সেই কাজে নিজেদেরও অংশ নেওয়া দরকার। সর্বোপরি, এই সময়টা নিয়ে ওরা যাতে অযথা চিন্তা না করে, সেটাও বাবা-মায়েদের দেখতে হবে। খোলাখুলি কথা বলে বোঝাতে হবে যে, এই সময় টা কেটে যাবে এবং সব পরিস্থিতিতে বাবা-মা তার সাথে আছে।”