ডাউন সিন্ড্রোম কেন হয়

ডাউন সিনড্রোম কী (Down syndrome), ডাউন সিনড্রোম কেন হয় এবং এটি প্রতিরোধের উপায় কী

ডাউন সিনড্রোম হল এক বিশেষ ধরনের জেনেটিক বা জিনগত অবস্থা বা ডিসঅর্ডার। ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষের ক্রোমোজোমের গঠন সাধারণ মানুষের ক্রোমোজমের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাঙ্গডন ডাউন ১৮৬৬ সালে এ শিশুদের চিহ্নিত করেন বলে তার নামানুসারে ডাউন সিনড্রোম কথাটি প্রচলিত হয়।প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ শিশুর মধ্যে একটি শিশু ডাউন সিনড্রোম বা ডাউন শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫০০০ বা প্রতিদিন প্রায় ১৫ জন ডাউন শিশুর জন্ম হয়।

ডাউন সিনড্রোম কেন হয় ?

ইতিমধ্যে জেনেছেন ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষে ২১ নম্বর ক্রোমোজমটির সঙ্গে আংশিক বা পূর্ণভাবে আরেকটি ক্রোমোজম (ট্রাইসোমি ২১) যুক্ত থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো, ২১তম ক্রমোজমের অসংগতির ফলে ডাউন সিনড্রোম দেখা দেয়, এটা জানা গেলেও ঠিক কোন কোন কারণে এ অসংগতি হতে পারে, এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আজো নিশ্চিত হতে পারেননি। 

ডাউন সিন্ড্রোম কত প্রকার ?

ডাউন সিন্ড্রোমের তিন প্রকার –

১) ট্রাইজোমি-২১ : এটি কোষ বিভাজনের অস্বাভাবিকতার কারণে হয়ে থাকে। একে ‘ননডিসজাংশন’ বলা হয়। ননডিসজাংশনে ২১ নাম্বার ক্রোমোজোমের ২টি কপির পরিবর্তে ৩টি কপি তৈরি হয়। এই অতিরিক্ত ক্রোমোজোম অন্য কোষে রেপ্লিকেশন শুরু করে দেয়। প্রায় ৯৫% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে ।

২) মোজাইক ডাউন সিন্ড্রোম : এটি একটি বিরল ধরনের রোগ, যেখানে একাধিক কোষে অতিরিক্ত ২১তম ক্রোমোজোমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে গর্ভসঞ্চারের সময় সুস্থ কোষের পাশাপাশি একাধিক বিকৃত কোষ জন্ম নেয়। প্রায় ১% রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগ দেখা দেয় ।

৩) ট্রান্সলোকেশন ডাউন সিন্ড্রোম : এক্ষেত্রে শরীরের ২১তম ক্রোমোজোমটি ভেঙে গিয়ে অন্য আরেকটি ক্রোমোজোম (সাধারণত ১৪ নাম্বার) এর সাথে যুক্ত হয়। প্রায় ৪% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে।

ডাউন শিশুদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য

ডাউন শিশুদের কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিস্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন-

  • মাংসপেশির শিথিলতা ।
  • বামন বা কম উচ্চতা বৃদ্ধি ।
  • চোখের কোনা উপরের দিকে উঠানো ।
  • চ্যাপ্টা নাক ।
  • ছোট কান ।
  • হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা থাকতে পারে ।
  • জিহ্বা বের হয়ে থাকা ।
  • শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক না-ও হতে পারে। 
  • পায়ের বুড়ো আঙুল ও তার পাশের আঙুলের মধ্যে অনেকটা ফাঁক থাকে। 

এই রোগের কিছু লক্ষণ

  • মাথার পিছনের দিকটা সমতল থাকা ।
  • চোখের দৃষ্টি হয় ভিন্ন ।
  • ছোট শরীর হয়ে থাকে ।
  • হাত বড় হয় কিন্তু আঙুল হয় ছোট ।
  • মেধা বা বুদ্ধাঙ্ক অনেকটাই কম হয় ।
  • শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হয় ধীরে ।

মানসিক বা আচরণগত সমস্যা

ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত একটি শিশু বয়সের সাথে সাথে অন্যস্বাভাবিক শিশুর মতো জ্ঞানীয় বা আচরণগত বিকাশ ঘটাতে পারে না। তাদের আবেগীয় বিকাশটি সঠিকভাবে হয়ে ওঠে না। ফলে আশেপাশের যেকোনো কিছুর প্রতি তাদের অতিরিক্ত আবেগ প্রদর্শন বা একদমই আবেগীয় কোনো অনুভূতি দেখা যায় না। কখনো বা খুব সাধারণ একটি শব্দে তারা ভয় পেয়ে চমকে ওঠে, কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার অনেক সময় এরাই অনেক ভয়ের বিষয় বা অনুভূতি প্রকাশ করার মতো ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে।

পেটের সন্তান ডাউন শিশু কি না তার নিশ্চিৎ পরীক্ষা

গর্ভের শিশুটি ডাউন শিশু কিনা তা নিশ্চিত করতে হলে বাচ্চার ডিএনএ পরীক্ষা করা দরকার। গর্ভাবস্থার ১১ হতে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক গর্ভফুল হতে কোষকলা সংগ্রহের (Chorionic Villus Sampling) মাধ্যমে অথবা ১৫ হতে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের বাচ্চার চারপাশের তরল পদার্থ সংগ্রহের (Amniocentesis) মাধ্যমে বাচ্চার ডিএনএ পরীক্ষা করে গর্ভের বাচ্চাটি ডাউন শিশু কি না তা ১০০ ভাগ নিশ্চিত করা যায়। এ সময় বাচ্চার আকার হয় প্রায় ২-৪ ইঞ্চির মতো। কাজেই রিপোর্ট অনুযায়ী বাবা-মা গর্ভাবস্থা চালিয়ে যাওয়ার ব্যপারে নিশ্চিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

কাদেরকে নিশ্চিত পরীক্ষা করতে বলা হয়

১. ঝুঁকি নির্ণয় পরীক্ষায় অর্থাৎ রক্ত পরীক্ষা ও আল্ট্রাসনোগ্রাফী পরীক্ষার রিপোর্টে যে সব গর্ভবতী মাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে

২. যে সব মায়ের আগে একটি ডাউন শিশুর জন্ম হয়েছে

৩. বাবা-মা ত্রুটিযুক্ত ক্রোমোজমের বাহক হলে

৪. অধিক বয়সের মা, বিশেষ করে পঁয়ত্রিশোর্ধ বয়সের গর্ভবতী মা

ডাউন সিন্ড্রোম

কিভাবে ডাউন শিশু সনাক্ত করা যায়

একজন চিকিৎসক যে কোন বয়সের শিশুকে দেখেই ডাউন শিশু কিনা তা সন্দেহ করতে পারেন। কারণ তাদের কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য থাকে। বাবা মায়েরা যখন দেখেন তাদের সন্তানের চেহারা একটু ভিন্ন ধরনের, শিশুর গায়ে শক্তি কম, নির্ধারিত বয়সে বসতে, দাঁড়াতে বা হাঁটতে শিখছে না, শারীরিক বৃদ্ধি কম, কম বুদ্ধি সম্পন্ন, তখন তারা চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন। চিকিৎসক শিশুর রক্তের ক্রোমোজম সংখ্যা বা ক্যারিওটাইপিং (Karyotyping) পরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন শিশু কি না তা নিশ্চিৎ করেন।

মনে রাখুন

৹ সময়মতো পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে হরমোনজনিত জটিলতাসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

৹ উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বড় করতে পারলে এই শিশুরা কর্মক্ষম হয়ে অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারে।

৹ মা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ করলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই সঠিক বয়সে সন্তান ধারণ করা উচিত।

৹ জন্মের পর বা বয়ঃসন্ধির সময় বা তার আগে মেয়েদের যদি ফলিক অ্যাসিড খাওয়ানো যায় তাহলে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর জন্মের হার কমানো সম্ভব । লেটুস, পালং শাক, ফুলকপি ইত্যাদির মধ্যে ফলিক অ্যাসিড থাকে। কিন্তু আমরা যেভাবে রান্না করি তাতে তার খাদ্যগুণ অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। তাই ওষুধ হিসেবে ফলিক অ্যাসিড খেলেই বেশি উপকার।

৹ সঠিক সময়ে লক্ষণগুলো চিহ্নিত করে সঠিক পরিচর্যা, পুষ্টিকর খাবার, স্পিচ, ল্যাঙ্গুয়েজ ও ফিজিক্যাল থেরাপি দিলে ডাউন শিশুরা অন্য স্বাভাবিক শিশুর মতোই পড়ালেখা করে কর্মক্ষম বা স্বনির্ভর হতে পারে। অথবা প্রয়োজনীয় পরিচর্যায় শারীরিক সমস্যাগুলো কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে।

প্রতিরোধের উপায়

সুযোগ ও সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশে এখনো বেশীরভাগ গর্ভবতী মা চিকিৎসকের তত্বাবধানে থাকতে পারেন না। অন্যদিকে চিকিৎসকের তত্বাবধানে থাকলেও গর্ভবতী মাকে ডাউন শিশু সম্পর্কে বা অন্য কোন জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার ব্যাপারটি উপেক্ষিত। তাছাড়া দেশের সব জায়গায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। অনেক প্রতীক্ষার পর কোন বাবা-মায়ের যখন একটি ডাউন শিশুর জন্ম হয় তখন ঐ সংসারে আনন্দের বদলে চরম হতাশা নেমে আসে। ডাউন শিশুদেরকে সাধারণ স্কুলে ভর্তি নেয়া হয় না। তাদের জায়গা হয় জটিল শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের বিশেষ স্কুলে। অথচ ডাউন শিশুরা অন্য প্রতিবন্ধী শিশুদের চেয়ে আলাদা এক বিশেষ শিশু। সাধারণ শিশুদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলে তাদেরও মেধা বিকশিত হয়ে স্বনির্ভরভাবে জীবনযাপন করতে পারে। শেষ পর্যন্ত ডাউন শিশুরা পরিবার, সমাজ ও দেশের বোঝা হয়ে থাকে। কাজেই সচেতন হওয়া ছাড়া প্রতিরোধের কোন উপায় নেই।

ভারতে এই ধরনের শিশুদের জন্মের হার একটু বেশি। সারা বিশ্বে যেখানে ৭০০ জন শিশুর মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়, সেখানে আমাদের দেশে ৬০০ জন শিশুর মধ্যে একজন এই রোগ নিয়ে জন্মায়। ভারতে প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ হাজার এই ধরনের শিশু জন্মায়।‌ উন্নত বিশ্বের মতো মায়ের গর্ভে ডাউন শিশু নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখন দেশেই হচ্ছে। আমাদের উচিত অন্যান্য দেশের মতো বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস পালনের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা। মেধাদীপ্ত শিশুর জন্ম নিশ্চিত করা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

You cannot copy content of this page