রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রন করার সহজ উপায়

কোলেস্টেরল এক ধরনের চর্বি যা মোমের মতো নরম। এটি আমাদের দেহের কোষের দেয়ালে থাকে। আমরা যখন ফ্যাট জাতীয় খাবার খাই, তখন আমাদের যকৃতে  কোলেস্টেরল তৈরি হয় এবং  রক্তের মাধ্যমে আমাদের দেহের সমস্ত রক্তনালিতে ছড়িয়ে পড়ে। যদি বেশি পরিমাণ ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়া হয় তবে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ধমনির দেয়ালে জমাট বেঁধে যায় এবং রক্ত চলাচলে বাধা দেয়।যার ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিকসমস্যা যেমন : উচ্চ রক্তচাপ, হৃৎপিণ্ডের নানা ধরনের অসুখ, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি দেখা যায়। 

সাধারণত দুই ধরনের কোলেস্টেরল আছে , একটি লো ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন (LDL) যাকে খারাপ কলেস্টেরল   এবং অপরটি হাইডেনসিটি লাইপো প্রোটিন (HDL) যাকে ভাল কলেস্টেরল বলা হয় । ভালো কোলেস্টেরল (Good Cholesterol) কোষের গঠনে একান্ত প্রয়োজনীয়। শরীরে একাধিক হরমোনের সৃষ্টির জন্যও শরীরে ভালো কোলেস্টেরল (HDL) প্রয়োজন। অপরদিকে শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL) মাত্রা বেড়ে গেলে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। খারাপ কোলস্টেরলের (Bad cholesterol) জন্য স্ট্রোকের ঝুঁকি ও হৃদরোগের (Heart Diseases) প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। 

কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা যে রকম হওয়া উচিত:

HDL: ৫০ mg/dL এবং তার উপরে

LDL: ১০০ mg/dL থেকে ১৫০ mg/dL

VLDL: ২৫ mg/dL এবং কম

TG- ১৫০ mg/dL এবং কম

শরীরে ১০০ mg/dl  কম এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল থাকলে কোনও ক্ষতি নেই। কারণ এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরিমাণ যদি বেড়ে ১০০ থেকে ১২৯ mg/ dl এর ভেতর থাকে তাহলে স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি। আর, ১৩০ থেকে ১৫৯ mg/dl  থাকলে তা বেশির দিকে বলে মনে করা হয়। ১৬০ থেকে ১৮৯ mg/ dl হলে বেশি বলে মনে করা হয়। তবে তা ১৯০mg/dl  ছাড়িয়ে গেলে খুব বেশি বলে মনে করা হয়।

রক্তের ধমনীতে বাধা দিয়ে এলডিএল কোলেস্টেরল হৃদপিণ্ডের ক্ষতি করে। কোলেস্টেরল বাড়ার কারণ কেবল খারাপ জীবনযাত্রা নয়, পারিবারিক ইতিহাসও এর জন্য দায়ী। তবে স্বাস্থ্যকর খাবার, হালকা ব্যায়াম এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

শরীরে কোলেস্টেরলের বাড় বাড়ন্ত কেন ঘটে, তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে –

●খাদ্যভাস: বেশ কিছু খাবারে স্বাভাবিকভাবেই কোলেস্টেরল থাকে। যেমন ডিম বা সামুদ্রিক খাবার ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো খুব বেশি খেলেই যে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাবেই, এমনটা নয় কিন্তু। যে সব খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ চর্বি রয়েছে, সেসব খাবার থেকে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির সম্ভবনা বেশি। যেমন খাসির মাংস, শক্ত চিজ, প্যাটিস, পেস্ট্রি ইত্যাদি। 

●ধূমপান ও মদ্যপান: অত্যধিক বেশিমাত্রায় তামাকজাতীয় দ্রব্য সেবন করলে বা মদ্যপান করলে রক্তে এল.ডি.এল-এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশষ্কা থাকে। তার থেকে হৃদযন্ত্রের বা শরীরের অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। 

রক্তে এল.ডি.এল কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে  বলা হয় হাইপারকোলেস্টেরলেমিয়া। 

লক্ষণ- 

1.বুকে মাঝে মাঝে যন্ত্রণা হতে থাকে।

2.এক্সারসাইজ করার সময় পায়ে ব্যথা হয়। 

3. রক্ত জমাট বেঁধে যেতে থাকে।  ফলে স্ট্রোক বা মিনি স্ট্রোক হতে পারে।

4..ত্বকে মোটা হলুদ ছোপ ধরতে থাকে। বিশেষ করে চোখের নীচে এই ছোপ পরিষ্কার বোঝা যায়। এই ছোপগুলো আসলে কোলেস্টেরল জমা হওয়ার লক্ষণ।

রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) নিয়ন্ত্রন করার সহজ উপায়-

  • আঙুর : আঙুরের ত্বক কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ অন্যতম ইপাদান। আঙুরের মধ্যে এমন এক উপাদান রয়েছে, যা শরীরের বদ কোলেস্টেরল বা এল.ডি. এল-কে আয়ত্তে রাখতে পারে।
  • রসুন: নিয়মিতভাবে পাঁচ-সাত কোয়া রসুন খেলে শরীরে এল.ডি. এল-এর পরিমাণ আয়ত্বের মধ্যেই থাকে। হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকে। এমনিতেই এর ওষধি গুণ যথেষ্ট। 
  • পেঁয়াজ: রসুনের মতো পেঁয়াজেও শরীরের বদ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। 
  • অ্যালোভেরা- প্রতিদিন খালি পেটে ৫০ গ্রাম অ্যালোভেরা খেলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
  • ওটস- ক্রমাগত  ৬ সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সকালে ব্রেকফাস্টে ওটস খেলে, এলডিএল কমে যায়।
  • গ্রিন ট্রি- কফির তুলনায় গ্রিন ট্রির মধ্যে ক্যাফিনের পরিমাণ কম থাকে। এর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি শরীরকে সুস্থ রাখে। প্রতিদিন গ্রিন ট্রি পান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়।
  • জগিং, ব্যায়াম ইত্যাদি অভ্যাস রাখতে হয় নিয়মিত। এর ফলে কোলেস্টেরলের এল.ডি.এল স্তর নিয়ন্ত্রণে থাকে। কারণ এই ব্যায়ামের ফলে শরীরের বাড়তি ক্যালোরি ঝরে যায়। ব্যায়ামের ফলে বাড়তি ওজন কমে। রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাছাড়া শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও কাজকর্ম স্বাভাবিক হয়। 
  • প্রাতরাশ বাদ দেওয়া যাবে না। বরং নিয়মিত পুষ্টিকর প্রাতরাশে শরীর অনেক বেশি  সুস্থ থাকে। বাড়তি কোলেস্টেরলের পরিমাণকে কমিয়ে ফেলতে পারে পুষ্টিকর নিয়মিত প্রাতরাশ। তবে প্রাতরাশে এমন খাবার রাখবেন, যাতে ফাইবার থাকে বেশি পরিমাণে।
  • তেলযুক্ত বা নুনযুক্ত খাবার কম করতে হবে। বেকারির খাবার যেমন কুকিজ, ক্র্যাকার ইত্যাদি খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে।ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলতে হবে। বেশিরভাগ ফাস্ট ফুডে অত্যধিক চর্বি রয়েছে। সেটা কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়।
  • খাবারের মধ্যে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার আর সবুজ শাকসবজি, গাজরের বেশি খেতে হবে। 
  • স্বাস্থ্যকর ফ্যাট  যেমন — কাঠবাদাম, চিনাবাদাম খেতে হবে; এগুলো শরীরে জমা Bad Fat কমাতে সাহায্য করে।
  • সকালে এবং বিকালে সম্ভব হলে ২বার হাটতে হবে। ২ঘন্টা অন্তর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আধা ঘন্টার বেশী একটানা বসে থাকা যাবেনা। 
  • প্রতি ৩ মাস অন্তর লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করতে হবে।

এলডিএলকে আমরা ঢালাওভাবে আখ্যায়িত করি বিষ বা সবচেয়ে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হিসেবে। কিন্তু এলডিএলের উপকারিতার কথা আমরা খুব কমই জানি। শিরা-উপশিরার দেয়াল স্বাভাবিক থাকলে এলডিএলের কারণে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বরং এলডিএল কোষ দেয়াল তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এলডিএলের মুখ্য ভূমিকা হল টেস্টোস্টেরন প্রস্তুত। টেস্টোস্টেরন হল একটি গুরুত্বর্পূণ সেক্স হরমোন, যার অভাবে যৌনবাসনা হ্রাস পায় বা বিলুপ্ত হয়।

আশা করি এই লেখা আপনার শরীর সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করবে এবং কোলেস্টেরল কমানোর এই সব উপায় আপনার জীবন অনেক সহজ করবে। তবে একথা ঠিক আমাদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ই একমাত্র এই রোগের কারণ।  যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে সঠিক খাবার এবং প্রতিদিন কিছু ওয়র্কআউট করা যায় তাহলে খুব সহজেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।  

3 thoughts on “রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রন করার সহজ উপায়”

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You cannot copy content of this page