pms

পিরিয়ড এবং মুড সুইং, অথঃ নারী কথা- শ্রীকনা সরকার

পিরিয়ডসের আগে বা পিরিয়ড চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে মুড সুইংয়ের শিকার হন নারীরা। বিরক্ত নয়, বরং সে সময় তার পাশে থাকুক বাড়ির পুরুষ মানুষটিও। 

পরিণত বয়সী নারীদের বেশিরভাগই এই ধরণের মুড সুইংয়ে আক্রান্ত। যাদের মধ্যে অধিকাংশই  পিরিয়ড বা মাসিকচক্রের আগে এর শিকার হন, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর প্রভাব নেতিবাচক হয়, এবং তাদের বেশকিছু মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ে অস্বস্তি, রাগ-ক্ষোভ, অভিমান, খিটখিটে মেজাজ থেকে শুরু করে মানসিকভাবে ভেঙে পড়াও লক্ষ্য করা যায়। এই লক্ষনগুলোকে একসাথে বলা হয় প্রিমেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম, বা  সংক্ষেপে পিএমএস নামেই বেশি পরিচিত।  আশার কথা হচ্ছে এই, লাইফস্টাইল পরিবর্তন ও মেডিকেশনের মাধ্যমে এই মানসিক পরিবর্তন অনেকটাই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

নিয়ন্ত্রণ হারায় আবেগেও :

পিএমএস নারীকে প্রতিমাসে এক অসম্ভব  মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন করে, কারনে অকারনে কান্না পাওয়া থেকে অকারণ অসম্ভব রাগেও ফেটে পড়েন কেউ কেউ। এরপর হয়ত একটি স্থিতিশীল মানসিক পর্যায়ে ফিরে আসেন তারা, অনেকক্ষেত্রেই এই পুরো ঘটনা টি একদিনের ভেতরই ঘটে।

মানসিক অবস্থার এই তারতম্যকে তখনই পিএমএস হিসেবে ধরা হয় যখন দেখা যায় প্রতি পিরিয়ডের ঠিক এক থেকে দু’সপ্তাহ আগে থেকে এই উপসর্গগুলো দেখা দিচ্ছে এবং পিরিয়ড শুরু  হওয়ার পর এক থেকে দু’দিন পর্যন্ত স্থায়ী  হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।

নারীদের শারীরবৃত্তীয় মাসিক চক্রকে কার্যক্রম অনুসারে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যার মধ্যে শেষ পর্যায়টিতে নারী পিএমএসে আক্রান্ত হন, যার পর শুরু হয় পিরিয়ড অর্থাৎ নতুন সাইকেল বা চক্র। আমরা জানি, নারীদেহে প্রতি মাসে ডিম্বাশয়ে একটি করে ডিম্বানু পরিনত হয়। আর এই পরিনত ডিম্বানুটি ডিম্বাশয় থেকে নির্গত হওয়াকে বলে ওভিউলেশন। পিএমএসের উপসর্গগুলো সাধারণত এই ওভিউলেশনের দিন থেকে শুরু হয় এবং পিরিয়ড শুরু হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে৷

পিএমএস’র সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ: 

অস্থিরতা, রাগ, হতাশা, অকারণ কান্না পাওয়া, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা, উদ্বিগ্নতা, অবসাদ ও বিষন্নতা।

পিএমএস এ মুড সুইং এর গোড়ার কথা:

যদিও গবেষকরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন ঠিক কী কী কারনে পিএমএস এভাবে আঘাত হানে, তবু পুরো মাসিক চক্র জুড়ে হরমোন মাত্রার ওঠা নামাকেই মানসিক এই পরিবর্তনের পিছনে কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা যায়, বিশেষ করে ইস্ট্রোজেন হরমোন। পিরিয়ড শুরু হওয়া মানেই নতুন একটি মাসিক চক্র শুরু হওয়া। এ সময় থেকে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়তে শুরু করে এবং ওভিউলেশন না হওয়া পর্যন্ত বাড়তে থাকে, ওভিউলেশনের সময় এটির মাত্রা সর্বোচ্চ থাকে। এরপর  ওভিউলেশনের পর থেকে পিরিয়ড শুরু হওয়া পর্যন্ত এর মাত্রা কমতে থাকে। পিরিয়ড শুরু হওয়ার প্রাক্কালে এর মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।

এরপর, পিরিয়ড শুরু হলে আবার আগের  মত এর মাত্রা বাড়তে শুরু করে। প্রতিমাসে হরমোনের এই কমা বাড়ার সাথে বাড়ে কমে নারীদের মুড সুইং সহ পিএমএসের অন্যান্য উপসর্গ।

দৈনন্দিন জীবনের জটিলতা বা স্ট্রেস, যেমন সম্পর্কের টানাপোড়েন , কেরিয়ারের স্ট্রেস, একাকীত্ব ইত্যাদি পিএমএস হওয়ার জন্য দায়ী নয়, তবে নিঃসন্দেহে এটি পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে। কিছু গবেষনায় বলা হয়, নারী শরীরের বিশেষ হরমোনগুলো কিছু ব্রেইন কেমিক্যালকে কমিয়ে মুডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন, সেরোটোনিন। এ বিষয়ে আরও বেশি গবেষনার অবকাশ আছে বলে চিকিৎসকরা মনে করেন। উল্লেখ্য, সেরোটোনিনের মাত্রা কমে গেলে হতাশা, বিষন্নতা, অস্থিরতা এবং কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারের প্রতি তীব্র আসক্তি তৈরি হয়।

periods

সিভিয়ার পিএমএস: 

তিন থেকে আট শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনেক বেশি গুরুতর আকার ধারন করে, এবং এই অবস্থাটির নাম দেওয়া হয়েছে প্রিমিন্সট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডার বা পিএমডিডি। পিএমডিডি আক্রান্ত রোগীরা পিরিয়ড শুরু হওয়ার এক দু সপ্তাহ আগে গভীর হতাশায় ডুবে যান এবং প্রচন্ড অশান্তি অস্থিরতা বোধ করেন।

পরিবারে ডিপ্রেশন রোগটির ইতিহাস থাকলে, বা রোগীর নিজের যদি প্রসবপরবর্তী ডিপ্রেশনের ( পোস্ট পারটম ডিপ্রেশন)  ইতিহাস থাকে, তাদের পিএমডিডি হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি।

পিএমডিডি নিশ্চিত করতে, পিরিয়ডের প্রাক্কালে নিচের উপসর্গগুলোর মধ্যে অন্তত পাঁচটি উপসর্গ থাকতে হবে-

১) গভীর হতাশা ও দুঃখবোধ, এমনকি আত্মহত্যার প্রবনতা

২) দীর্ঘক্ষনের ক্রোধ ও অস্থিরতা, প্রিয়জনের উপর রাগে ফেটে পড়ার মত ঘটনা। 

৩) দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা

৪) আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থা 

৫) ঘনঘন মুড পরিবর্তন 

৬) কান্না পাওয়া

৭) দৈনন্দিন কাজ ও মানুষের সাথে মেলামেশায় অনীহা

৮) মনোযোগহীনতা

৯) আবেগ নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাওয়া

১০)  অবসাদ

১১) ক্লান্তি

১২) অহেতুক অতিরিক্ত ক্ষিদে পাওয়া

এই লক্ষনগুলো পিএমএসের মতই পিরিয়ড শুরু হওয়ার সাথে সাথে মিলিয়ে যেতে শুরু করে। যদি তা না হয়ে এটি সারা মাসব্যাপী স্থায়ী হয়, তবে, এটি পিএমডিডি নয়। এর পেছনে আপনাকে খুঁজতে হবে, অন্য কোন মানসিক বা শারীরিক অসুস্থতা।

পিএমএসের চিকিৎসা:

অনেকে কেবল মাত্র লাইফস্টাইল পরিবর্তন করে পিএমএস প্রতিরোধে সফল হন। অনেকের ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।

কিছু টেকনিক ও কিছু ট্রিটমেন্ট মাসের এই সপ্তাহগুলোতে আপনার জন্য অনেকটা ভালো ফল দিতে পারে। যেমন-

Health consultation

ব্যায়াম:

কায়িক শ্রম আমাদের ডিপ্রেশন কমাতে ও মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। বলা হয়ে থাকে, এক্সারসাইজের সময় ব্রেন থেকে এন্ডোরফিন নামের একটি কেমিক্যাল বের হয়, যেটি আমাদের মনেএকধরনের সুখানুভূতি তৈরি করে, এবং পিএমএসের জন্য দায়ী ক্ষতিকারক হরমোনগুলোকে প্রতিহত করে।

পরিমানে কম, কিন্তু বারেবারে খাবার:

এক্সাইসাইজ আমাদের এনার্জি লেভেলকে বুস্ট আপ করে আমাদেরকে কর্মোদ্যোম  করে তোলে। অ্যারোবিক এক্সারসাইজ যেমন হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো ও  সাঁতারকে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে।

দিনে দুটি বা তিনটি বড় মিলের পরিবর্তে, সারাদিন ধরে ছোট ছোট মিল নিতে হবে। কারন, অনেকখানি খাবার একসাথে, বিশেষ করে শর্করা জাতীয় খাবার খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাবে, যাকে ব্লাড সুগার সুইং বলা হয়, যার ফলে পিএমএস প্রচণ্ড আকার ধারন করবে। আবার দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে গেলে, অস্থিরতা বোধ হবে, এমনকি কান্নাও আসতে পারে।

তাই, সারাদিনের খাবারকে ছয়টি ছোট ছোট মিলে ভাগ করে নিয়ে খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা স্থিতিশীল থাকবে।

ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট:

ক্লিনিক্যান ট্রায়ালে দেখা গেছে, যেসব নারী ৫০০ মিলিগ্রাম করে দিনে দুবেলা ক্যালসিয়াম গ্রহণ করেছেন, তারা অন্যান্যদের চেয়ে হতাশা ও অবসাদের শিকার কম হয়েছেন।

অনেকগুলো গবেষনায় দেখা গেছে, ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার পিএমএস ও সেই সংক্রান্ত  মুড সুইং এর উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যদিও কীভাবে এটি কাজ করে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ক্যাফিন, অ্যালকোহল ও মিষ্টি জাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে। 

পিরিয়ডের দুই সপ্তাহ আগে থেকে যদি কফি ও ক্যাফিন সমৃদ্ধ পানীয় না নেওয়া হয়, তবে মুডের উপর এর ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে।

কারন ক্যাফিন আমাদের মনে অস্থিরতা বৃদ্ধি করে এবং ইনসোমনিয়াতে ভোগায়। অ্যালকোহল বর্জন করার সুফলও পাওয়া যাবে, কারন অ্যালকোহল আমাদের বিষন্ন  করে তোলে। এছাড়া, চকলেট , সোডাযুক্ত সফট ড্রিঙ্ক, মিষ্টি জাতীয় খাবার বর্জন করে রক্তে শর্করার পরিমান নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যেহেতু রক্তে শর্করার তারতম্য মুডের তারতম্য তৈরি করে।

স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট:

স্ট্রেস পিএমএসকে সবচেয়ে গুরুতর করে তোলে। সুতরাং, স্ট্রেসের কারন জানা এবং তার প্রতিকার জরুরি।

মেডিটেশন, যোগাসন, শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মত কিছু  চর্চা করা ভালো। প্রয়োজনে, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপী নিতে হবে।

কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট যেমন সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর রক্তে সেরোটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে পিএমএস ও পিএমডিডি উপশমে সাহায্য করে।

প্রয়োজনে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করতে হবে, কারণ তিনিই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করবেন। তারও আগে পিএমএস সম্পর্কে জানতে হবে, এবং বাড়ির বাকি সদস্যদেরও জানাতে হবে। এই সচেতনতা, একদিকে যেমন আক্রান্তের শারীরিক ও মানসিক ধকল সামলাতে সাহায্য করবে, তেমনি পরিবার পরিবেশকে, বিশেষ করে সঙ্গীকে, আক্রান্তের প্রতি সহমর্মী করে তুলবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

You cannot copy content of this page