বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ – বুকের দুধই শিশুর চিকিৎসার ও রোগ মুক্তির প্রথম চিকিৎসক

১ থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। শিশুর জীবনের শুভসূচনা মায়ের দুধের মাধ্যমে। মায়ের দুধ শিশুর জন্য সর্বোত্তম খাবার এবং শালদুধ শিশুর জীবনের প্রথম টিকা। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকে দিলে শিশু মায়ের দুধে তাড়াতাড়ি অভ্যস্ত হয় এবং মায়ের দুধ তৈরি হতে সাহায্য করে।

মাতৃদুগ্ধ কি ?

বুকের দুধ বা মায়ের দুধ হলো একটি ছোট শিশুকে খাওয়ানোর জন্য কোনো মহিলার স্তনে অবস্থিত স্তন্যপায়ী গ্রন্থিগুলির দ্বারা উৎপাদিত দুধ । নবজাতকের অন্যান্য খাবার খাওয়ার এবং হজম করার আগে মায়ের দুধই পুষ্টির প্রাথমিক উৎস।

মাতৃদেহে কিভাবে উৎপাদন হয় ?

হরমোন প্রোল্যাকটিন এবং অক্সিটোসিনের প্রভাবে মহিলারা সন্তান প্রসবের পর শিশুকে খাওয়ানোর জন্য দুধ উৎপাদন করে। উৎপাদিত প্রাথমিক দুধকে কলস্ট্রাম হিসাবে উল্লেখ করা হয়, যাতে ইমিউনোগ্লোবুলিন আইজিএ বেশি থাকে। যা পরিপাক নালিকে আবরণ করে ।পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদন করতে না পারার অক্ষমতা বিরল। গবেষণায় দেখা গেছে যে অপুষ্ট অঞ্চলের মায়েরা এখনও উন্নত দেশগুলির মায়েদের মতো একই পরিমাণের দুধ উৎপাদন করে।

উপাদান

প্রসবের পরে প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে, মা শালদুধ উৎপাদন করে। এটি একটি পাতলা হলুদ তরল যা একই তরল যা কখনও কখনও গর্ভাবস্থায় স্তন থেকে বের হয়। এটি প্রোটিন এবং অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ যা শিশুকে নিষ্ক্রিয় প্রতিরক্ষা সরবরাহ করে (শিশুর প্রতিরোধ ব্যবস্থা জন্মের সময় পুরোপুরি বিকশিত থাকে না)। শালদুধ নবজাতকের পাচনতন্ত্রকে সঠিকভাবে বৃদ্ধি এবং কার্যক্ষম করতে সহায়তা করে।শালদুধ ধীরে ধীরে পরিপক্ব দুধে পরিনত হয়। প্রথম ৩-৪ দিন এটি পাতলা এবং পানিযুক্ত দেখা যায় এবং খুব মিষ্টি স্বাদের হয়। পরে দুধ ঘন এবং ক্রিমসমৃদ্ধ হবে। মানুষের দুধ শিশুর তৃষ্ণা ও ক্ষুধা নিবারণ করে এবং শিশুর প্রয়োজনীয় প্রোটিন, চিনি, খনিজ এবং অ্যান্টিবডি সরবরাহ করে।প্রধান প্রোটিনগুলি হল আলফা- ল্যাক্টালবুমিন, ল্যাক্টোফেরিন (এপো-ল্যাকটোফেরিন), আইজিএ, লাইসোজাইম এবং সিরাম অ্যালবুমিন । ল্যাক্টালবুমিন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের সুরক্ষায় অবদান রাখবে বলে মনে করা হয়।

1.মায়ের দুধে পুষ্টি উপাদান ছাড়াও রয়েছে ৯০ ভাগ জল। এ জন্য শিশুকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত আলাদা জল দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

2. মায়ের দুধে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড (লিনোলিক এসিড) আছে, যা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ, চক্ষু ও রক্তনালি গঠনের জন্য প্রয়োজনীয়।

3.বুকের দুধে মিনারেল, ফ্যাট, ভিটামিন, পানি ছাড়াও থাকে বিশেষ ধরনের ফ্যাটি এসিডও, যা শিশুর চোখের জ্যোতি বাড়াতে সাহায্য করে।

মাতৃদুগ্ধ পানের উপকারিতা

 শাল দুধের উপকার

(১) শালদুধ শিশুর জন্য এতটা উপকারি যে যা শিশুর জীবনের প্রথম টিকা হিসাবে গন্য করা হয়।

(২) শালদুধ আমিষ সমৃদ্ধ এবং এতে প্রচুর ভিটামিন-এ আছে।

(৩) শালদুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ায়।

(৪) শালদুধ শিশুর পেট পরিষ্কার করে এবং নিয়মিত পায়খানা হতে সাহায্য করে।

(৫) শিশুর জন্ডিস হবার সম্ভাবনা কমে যায়।

পরিণত দুধের উপকার

(১) মায়ের দুধে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান সঠিক মাত্রায় থাকে। ছয়মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট। মায়ের দুধে পুষ্টি উপাদান ছাড়াও আছে শতকরা ৯০ ভাগ জল সেইজন্য শিশুকে 6  মাস বয়স পর্যন্ত আলাদা করে জল দেবার প্রয়োজন নেই।

(২) মায়ের বুকের দুধ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত। বায়ু বা পানি বাহিত জীবানু দ্বারা সংক্রমিত হবার সুযোগ নেই। উপরন্ত মায়ের দুধে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায়-যার ফলে শিশুর অসুখ বিসুখ বিশেষ করে ডায়রিয়া, কানপাকা, নিউমোনিয়া, শ্বাসনালীর রোগ, হাঁপানী, এলার্জি, চুলকানি ইত্যাদি কম হয়।

(৩) মায়ের দুধে শিশুর বুদ্ধি বাড়ে। তাছাড়া স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে।

(৪) অসুখ হলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী থাকার কারণে শিশু তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যায়।

(৫) মায়ের দুধ শিশু মৃত্যুর হার কমায়।

(৬) মায়ের দুধ সহজে হজম হয় ।

(৭) মায়ের দুধে পূর্ণমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ থাকে বলে শিশুর রাতকানা হবার সম্ভাবনা থাকে না।

(৮) এছাড়া পরবর্তীতে শিশুর অ্যাকজিমা, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি ভয়াবহ রোগ হাবর সম্ভবনা কমে যায়।

এছাড়াও মায়েরও বিশেষ কিছু উপকারিতা রয়েছে :

(১) জম্মের সাথে সাথে শিশুকে বুকের দুধ দিলে মায়ের প্রসবজনিত রক্তপাত বন্ধ হয। পরবর্তীতে রক্তস্বল্পতা হয় না। মায়ের গর্ভফুল পড়তে সাহায্য করে, জরায়ু তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

(২) মায়ের স্বাস্থ্য ভাল থাকে।

(৩) যে সব মা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের স্তন, জরায়ু এবং ডিম্বকোষের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা কম থাকে।

(৪) ছয় মাস বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ালে স্বাভাবিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে এবং ২ বৎসর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ালে ঘন ঘন গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা কমে যায়।

(৫) মায়ের দুধ খাওয়ালে মায়ের আত্নবিশ্বাস বাড়ে।

(৬) মায়ের দুধ খাওয়ালে মা ও শিশুর মধ্যে সম্পর্ক নিবিড় হয়।

(৭) মায়ের দুধ নিরাপদ, ঝামেলামুক্ত এবং মায়ের বাড়তি খাটুনি ও সময় বাঁচায় এবং অর্থের সাশ্রয় হয়।

(৮) রাতে শিশু মায়ের কাছে শোয়া থাকে বলে মা শিশুকে যখন খুশী তখন শুয়ে শুয়ে খাওয়াতে পারেন।

পরিবারের জন্য উপকার

(১) মায়ের দুধ খাওয়ালে শিশুর জন্য বাড়তি দুধ, দুধ খাওয়ার জন্য সরঞ্জাম যেমন বোতল, নিপল ইত্যাদি কেনার খরচ, বাড়তি পরিষ্কারের জন্য বিশুদ্ধ পানি এবং জ্বালানী ইত্যাদির খরচ বাঁচে।

(২) শিশুর রোগ কম হয় বলে চিকিৎসা খরচ যেমন ঔষধ, ডাক্তার এবং হাসপাতালে ভর্তির খরচ বাঁচে ।

সুতরাং, বুকের দুধই শিশুর চিকিৎসার ও রোগ মুক্তির প্রথম চিকিৎসক যা চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি ।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You cannot copy content of this page