denge

ডেঙ্গু জ্বর এর বাড়বাড়ন্ত ! এর লক্ষণ, কারন এবং প্রতিকার সম্পর্কে জানুন বিস্তারিত

“ডেঙ্গু এখন আতঙ্কের নাম” কারণ প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী ভর্তি হচ্ছে নানা হাসপাতালে এই রোগের লক্ষণ নিয়ে। যে কোনো কারণেই হোক, এবার মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সফলতার মুখ দেখেনি। ডেঙ্গু রোগের সাধারণ লক্ষণ যেসব থাকে তা অন্য ভাইরাস রোগের মতোই। অনেকেই তাই নিজ উদ্যোগে চিকিৎসা নিয়েছে এত দিন। কিন্তু এবার ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ পাল্টেছে। ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত একটি জ্বর। ডেঙ্গুর তেমন কার্যকরী প্রতিষেধক নেই। এ থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে একে প্রতিরোধ করা। তাই ডেঙ্গু জ্বর সচেতনতা সম্পর্কে আলোকপাত করছি। 

ডেঙ্গু জ্বর কী?

ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়।কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়।

কীভাবে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটে ?

ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক অ্যাডিস ইজিপটি নামক মশা। এ ছাড়া অ্যাডিস অ্যালবপটিকাস দিয়েও এ রোগের বিস্তার হয়। অ্যাডিস নামে মশাগুলো অন্যান্য মশার চেয়ে বড় এবং গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে। এরা বৃষ্টি-পরবর্তী সময়ে যেকোনো জলাবদ্ধ এলাকায় বংশবিস্তার করে।  তা ছাড়া ঘরে রাখা টব বা ফুলদানির পানিতেও এরা বংশবিস্তার করে।ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ হয় দিনের বেলায়।  ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়।এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।

ডেঙ্গু জ্বর এর লক্ষণ কী ?

ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়।  এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাঁড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’।

জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচদিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়। যাকে বলা হয় স্কিন র‍্যাশ, অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এর দুই বা তিনদিন পর আবার জ্বর আসে। একে ‘বাই ফেজিক ফিভার’ বলে।

ডেঙ্গু জ্বর প্রকারভেদ কী ?

ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের হয়। এক. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার।  দুই. হেমোরেজিক ফিভার। 

১. ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর – এই অবস্থাটা সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরো যে সমস্যাগুলো হয়, সেগুলো হলো : 

•    শরীরে বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন : চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সাথে, রক্ত বমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে রক্ত পড়তে পারে। মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি হতে পারে।

•    এই রোগের বেলায় অনেক সময় বুকে ,পেটে জল  ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।

২. ডেঙ্গু শক সিনড্রোম – ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াভহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো :

•    রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া।

•    নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হওয়া।

•    শরীরের হাত-পা ও অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়।

•    প্রস্রাব কমে যায়।

•    হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। 

•    এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

ডেঙ্গু জর

ডেঙ্গু জ্বর এর কারণ

ডেঙ্গি ভাইরাস মশা, বিশেষ করে এডিস ইজিপ্টি দ্বারা বাহিত হয়। এইসব মশা ভোরবেলা এবং মাঝ রাতের পর কমড়ায়। এক কামড়েই সংক্রমণ হতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বর এর উপসর্গ

ডেঙ্গি জ্বর সঠিকভাবে চিকিৎসা করা গেলেও, চিকিৎসা না করালে প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই, গোড়াতেই রোগ নির্ণয় করতে ডেঙ্গির উপসর্গ জানা গুরুত্বপূর্ণ।যারা ডেঙ্গিতে ভোগে তাদের সাধারণত এইসব উপসর্গ দেখা যায়:

1. প্রচন্ড জ্বর

2. মাথা ব্যাথা

3. বমি করা

4. পেশী ও গেঁটে ব্যাথা

5. ত্বকে ফুসকুড়ি

এইসব উপসর্গ মানেই যে ডেঙ্গি এমন কোন বিষয় না হলেও এইসব উপসর্গ আপনার দেখা দিলে পরীক্ষা করানো বাঞ্ছনীয়। তবে, এগুলি হল রোগের গোড়ার দিকের উপসর্গ। কিছু ব্যক্তি এগুলি উপেক্ষা করেন, ফলে ডেঙ্গি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, যেখানে উপসর্গগুলি হল:

1. রক্তপাত

2. রক্তে কম প্লেটলেট// অ্যানোফেলিস মশা

3. রক্তের প্লাজমা লিকেজ

4. কম রক্তচাপ।

ডেঙ্গু জ্বর হলে রক্তের প্লেটলেটের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে, কমতে কমতে ২০০০০ পর্যন্ত নেমে যেতে পারে, যেখানে একজন সুস্থ লোকের প্লেটলেটের সংখ্যা ১.৫ থেকে ২ লাখের মধ্যে থাকে।

ডেঙ্গু রোগীর খাদ্যাভ্যাস

১) তরল জাতীয় খাবার –

এ সময় শরীরে প্রচুর তরল জাতীয় খাবার প্রয়োজন। চিকিৎসকদের মতে একজন ডেঙ্গু রোগীর দৈনিক ৩ লিটার বা ১২ গ্লাস জলের প্রয়োজন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অরুচির জন্য শরীরে জলের  পরিমাণে যথেষ্ঠ ঘাটতি দেখা দেয়। তাই পানির পাশাপাশি বিভিন্ন ফলের যেমনঃ আম, মাল্টা, লেবু, বেদানা বা আনার, আপেল, আনারসের রস দেওয়া যেতে পারে।

২) শর্করা ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য

ক্ষুধামন্দা সত্বেও রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করা ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য যেমনঃ নরম ভাত, ডাল, ডিম, মাছ, মাংস খেতে হবে। তবে যেহেতু এ সময় অনেকের বদহজম বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাও দেখা দিতে পারে তাই তারা ডিমের কুসুমের অংশটি বাদ দিতে পারে।

পাতলা ঝোল

৩) পাতলা ঝোল 

কোনোভাবেই এ সময় অতিরিক্ত তেল, মশলা দিয়ে রান্না করা খাবার বা বাইরের জাংক ফুড জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। মাছ বা মাংসের ভুনা না খেয়ে সিদ্ধ করে পাতলা ঝোল করে খেতে হবে।

৪) স্যুপ 

বেশি মশলা দিয়ে রান্না করা মাংসের চেয়ে সহজপাচ্য ঝোল বা স্যুপ বেশি উপকারী। কয়েক রকমের সবজি সিদ্ধ করে স্যুপ অথবা টমেটো স্যুপ, চিকেন স্যুপ, কর্ন স্যুপ খেলে অনেক সময় অরুচি কাটে, আবার শরীরের পানির চাহিদাও পূরণ হয়।

খাবারগুলো বেশি করে খাবেন –

পেঁপে পাতার জুস : ডেঙ্গু জ্বর হলে রোগীর শরীরে কমে যেতে পারে প্লেটলেট। তাই এ সময় আপনার উপকার করতে পারে পেঁপে পাতা। পেঁপে পাতায় পাপাইন এবং কিমোপেইনের মতো এনজাইম সমৃদ্ধ যা হজমে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি করেতে পারে প্লেটলেটের পরিমাণও।

ব্রুকলি : ব্রুকলি হলো ভিটামিন কে’র একটি ভালো উত্স। অন্যদিকে ভিটামিন কে রক্তের প্লেটলেট বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

পালংশাক : পালংশাকে প্রচুর পরিমাণে আইরন এবং ওমেগো-থ্রি ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। এটি আবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেতে সহায়তা করে।

ভিটামিন সি : এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দারুন কার্যকরী। এ কারণে ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন- কমলা, আনারস, স্ট্রবেরী, পেয়ারা –এসব ফল বা ফলের জুস খেতে দিন।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের সবার সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রত্যেকে নিজের ঘর আর আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলে এডিস মশা বংশ বিস্তার করতে পারবে না। সবার সুস্থতা কামনা করে আজকে এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!                                   “প্রতিকার নয় প্রতিরোধ উত্তম”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

You cannot copy content of this page