অনিদ্রা ( Insomnia ) একটি ঘুমের রোগ। এক্ষেত্রে রোগীর ঘুম হয় না। যার ফলে সারাদিন ক্লান্ত লাগে, কাজে মন বসে না, দুশ্চিন্তা হয়, মাথা ব্যাথা করে, বিরক্তভাব লাগে, অবসাদ হয় ও অন্যান্য নানান সমস্যা দেখা দেয়। ঘুম না হলে শারীরিক ক্ষতিও হতে পারে, যেমন, ওজন বেড়ে যাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া এমন অনেক কিছু।তবে জীবনযাপনের জটিলতা ও খাদ্যাভ্যাসের অনিয়ন্ত্রণই অনিদ্রার অসুখকে ডেকে আনে বলে মত চিকিৎসকদের।
একটু নিশ্চিন্তের ঘুমের জন্য ওষুধ, ঘরোয়া উপায় বা খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন— কত কিছুই না করা হয়। ঘুমের ওষুধ একটানা খেয়ে যাওয়াও ক্ষতিকারক।কিছু সাধারণ খাবারও হতে পারে ঘুমের ওষুধের বিকল্প যার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। তাই অনিদ্রার সমস্যার সমাধানের জন্য নির্ভয়ে এবং নির্বিঘ্নেই খেতে পারেন এই সব খাবার।আজ জেনে নিন তেমনই কিছু খাবারের সম্পর্কে –
1.গরম দুধ : গরম দুধে আছে ট্রাইপটফান যা অনিদ্রা দূর করে ভাল ঘুম হতে সাহায্য করে। রাতে ঘুমানোর আগে ১ কাপ গরম দুধ পান করতে হবে।
2.কলা : কলাতে থাকে এমিনো এসিড অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটা বার বার ঘুম ভেংগে যাওয়ার সমস্যাও তাড়ায়। এতে আছে ক্যালসিয়াম,আয়রন, পটাসিয়াম এবং অন্যান্য মিনারেলস যা মনকে শান্ত করে।
3.সিদ্ধ আলু বা রান্না করা আলু : আলু খেলে ট্রাইপটোফানের সাহায্যে হাই তোলায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী এসিড নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্ক বেশ দ্রুত ঘুমাতে সাহায্য করে।
4. বাদাম : রাতের ঘুমের জন্য আরেকটি উপকারী খাবার। যাদের রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয় তারা প্রতিদিন রাতের খাবারে ১০ থেকে ১২ টি বাদাম খেলে রাতের ঘুম ভালো হবে।
5. জিরা : জিরা রান্না ঘরের পরিচিত একটি মসলা। হজম শক্তি বাড়াতে এটা খুব কার্যকরী। ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে জিরা চা খাওয়া যেতে পারে। চা তৈরি করতে, প্রথমে জিরা হালকা আঁচে ভেজে নিয়ে তারপর এক কাপ জলের সাথে ভাজা জিরা ফুটিয়ে ৫ মিনিট রেখে দিতে হবে। রাতে জল ছেঁকে ঘুমানোর আগে পান করতে হবে।
6. জায়ফল : জায়ফলে স্নায়ুর উত্তেজনা কমিয়ে মনকে শান্ত করার সব উপদান আছে। ফলে অনিদ্রা দূর হয় এবং গভীর ঘুম হয়। ১ চা চামচ জায়ফলের গুড়ার ১ কাপ গরম জলের সাথে মিশিয়ে ঘুমানোর আগে পান করলে উপকার হয়।
7. মেথির রস : মেথি দুশ্চিন্তা, হতবিহবল ও অনিদ্রা দূর করে। ২ চা চামচ মেথি পাতার রসের সাথে ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে বা মেথি শাক বা মেথি পরটা খাওয়া ভালো।
8.ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার : ম্যাগনেসিয়াম হলো এমন একটি খনিজ যা পেশীকে শিথিল করতে এবং স্ট্রেস কম করতে সাহায্য করে। তাই যে সব খাবারে ম্যাগনেসিয়াম আছে সেগুলো খাওয়া উপকারী। ডার্ক চকোলেট, বাদাম, অ্যাভোকাডো এগুলোতে ম্যাগনেসিয়াম আছে।
9.টম্যাটো, বেদানা, শসা, ব্রোকোলি, সর্ষে, আখরোট ইত্যাদিতে মেলাটোনিন থাকে। এগুলো প্রতিদিনের ডায়েটে যোগ করলে (Natural Treatment of Insomnia) ঘুমের সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। সূর্যের আলোতেও কিন্তু মেলাটোনিন থাকে তাই সূর্যের আলো গায়ে লাগানো ভাল।
স্বাভাবিক বা সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। কাজের চাপ বা ব্যস্ততা খুব বেশি থাকলেও প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। দিনে ছয় ঘণ্টার কম ঘুমালে সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে সাধারণত, পূর্ণবয়স্ক মানুষদের ৭-৮ ঘণ্টা, শিশুদের ৯-১৩ ঘণ্টা, একেবারে ছোট বাচ্চাদের ১২-১৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুমানোর সময় শরীরের কোষগুলো বিশ্রাম পায় এবং সেই সঙ্গে শরীর থেকে বেরিয়ে যায় টক্সিন নামক একটি পদার্থ। ভালো ঘুম ওষুধের থেকেও ভালো কাজ করে।
যদি ঘুমের সমস্যার মাত্রা অনেক বেশি হয়, তাহলে প্রথমে যে কারণে ইনসমনিয়া হচ্ছে সাধারণত তার চিকিৎসা করা হয়। যদি এতে ইনসমনিয়া ভালো না হয়, তাহলে আপনাকে কাউন্সেলিং (counselling) এবং বিহেভিওরাল থেরাপি (behavioral therapy) করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। এটাতে যে কাজে ইনসমনিয়া বাড়ে সেগুলো বাদ দিতে আপনাকে সাহায্য করা হয় এবং যেসব ব্যবহারে ঘুম ভালো হয় সেগুলো শেখানো হয়।
এছাড়াও অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া দূর করার কিছু সহজ ঘরোয়া কৌশল আছে –
■পাশাপাশি ক্যাফেইনজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। চা, কফি, এনার্জি ড্রিঙ্কস খেলে অনিদ্রার সমস্যা আরও বাড়বে।
■ঘুমানোর আগে পেট ভরে অতিরিক্ত খেলে ঘুম ভালো নাও হতে পারে। তাই যাদের রাতে ঘুমের সমস্যা আছে, তাদের অবশ্যই ঘুমানোর 2 / 3 ঘণ্টা আগেই রাতের খাবার সেরে নিতে হবে।

■নিয়মিত শরীরচর্চা করলে অনিদ্রার সমস্যা দ্রুত সেরে যায়।ঘুমানোর আগে গভীর নিঃশ্বাস এর ব্যায়াম করতে পারেন। এতে শরীর ও মন দুটোই রিল্যাক্সে থাকে ।
■প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে হবে । এমনকি ছুটির দিনেও করতে হবে একইভাবে।
■ঘুমের আগে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার, টিভি দেখা, গেমস খেলা বন্ধ করতে হবে।
■দিনের বেলা আধ ঘন্টার বেশি ঘুমান যাবেনা।
■মদ্যপান ও ধূমপান নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এগুলো কিন্তু ঘুম না আসার মূল কারণ।
রাতে নয় ঘণ্টার বেশি ঘুমাচ্ছেন এমন ব্যক্তি, যারা আগে এর চেয়ে কম, অন্যদের তুলনায় তাদের অ্যালঝেইমার রোগে আক্রান্ত হবার শঙ্কা দ্বিগুণ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে ঘুমের ভেতরে মানুষের স্মৃতি তৈরি হয়, বিশেষ করে হালকা ঘুমের সময়।সেক্ষেত্রে একটানা দীর্ঘ ঘুম সেই প্রক্রিয়ায় বাঁধা দেয়।নিয়মিত জীবনযাপনেই আসলে সুস্থ থাকা যায়। তাই, পর্যাপ্ত ঘুমান ও নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া ও সুস্থ জীবন পরিচালনার মাধ্যমে দূরে রাখুন ইনসমনিয়াকে।